সারাবছরের স্থায়ী দুর্যোগে রূপ নিচ্ছে বজ্রপাত - NewsPhour

Breaking News

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Post Top Ad

Responsive Ads Here

Thursday, October 10, 2019

সারাবছরের স্থায়ী দুর্যোগে রূপ নিচ্ছে বজ্রপাত

বজ্রপাত এখন সারা বছরের দুর্যোগ হিসেবে স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে শীত আসছে, তবু রেহাই মিলছে না বজ্রপাতের হাত থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে সাধারণত গ্রীষ্মকালের শুরু থেকেই বজ্রপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়। কিন্তু মার্চেও শেষ ভাগ থেকে জুনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বজ্রপাত আঘাত হানে। চলতি বছরের আবহাওয়া বিশ্লেষণে অবশ্য দেখা যাচ্ছে অক্টোবরে বজ্রপাতের আঘাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও বিকাশমান অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রেক্ষিতে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির বহুমাত্রিক ব্যবহারের কারণে দেশে ক্রমেই বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশঙ্কাজনক হারে ঘটছে প্রাণহানি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের বজ্রপাতে মৃত্যুর ৪০ ভাগ মে মাসে ঘটছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে বজ্রপাতে মৃত্যুর এক চতুর্থাংশ ঘটছে বাংলাদেশে।

সম্প্রতি নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশের সুনামগঞ্জে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতে আঘাত হানছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের পূর্বাঞ্চলে বেশি বজ্রপাতের কারণ হিসেবে তারা ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যকে দায়ী করেছেন। মূলত স্যাটেলাইট থেকে নেয়া ১০ বছরের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

এতে বলা হয়েছে, ভারতের খাসি পাহাড় ও মেঘালয় এলাকায় মে মাস পর্যন্ত ঘন ঘন মেঘ জমে। স্তরীভূত মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জে বজ্রপাতের পরিমাণ বেশি। প্রতিবছর মার্চ থেকে মে মাসের শেষ দিকে বোরো ধান কাটতে হাওড়ে বেশিসংখ্যক মানুষ থাকায় হতাহতের ঘটনা বেশি হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, বজ্রপাতের ৯৪ ভাগ গ্রামীণ জনপদে। এর মধ্যে উন্মুক্ত স্থানে ৮৬ ভাগ মানুষ মারা যাচ্ছে।



Courtesy: www.freepik.com


বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম ফারুক তার গবেষণায় বলেন, কৃষক-শ্রমিক ও জেলে পেশার লোকজন বজ্রপাতের বেশি বলি হচ্ছে। কারণ কৃষি জমিতে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ভারি ধাতব কৃষি যন্ত্রাংশ। যা বজ্রপাত টেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা পালন করছে।

বজ্রপাতের সঠিক কারণ কি আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে না পারলেও তারা জলব্য়াু পরিবর্তনকে এর পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। সম্প্রতি গবেষকরা বলছেন, এর পেছনে বায়ু দূষণও অন্যতম কারণ।

তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কলিন প্রাইস তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, বায়ু দূষণের সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। নাসার সহায়তা নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় একদল গবেষক দেখতে পেয়েছেন বজ্রপাতের পরপরই বায়ুম-লের সর্বনি¤œস্তরে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন অক্সাইড তৈরি হয়। কার্বনডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইডের চেয়েও বিষাক্ত এই নাইট্রোজেন অক্সাইড রূপান্তরিত হয় ওজোন গ্যাসে। সেই গ্যাস বাতাসের এমন একটি স্তরে জমে থাকছে যে এর ফলে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তারা আরও উল্লেখ করেছেন, বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট দূষিত অক্সাইড পরিবেশ দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খোলা জায়গা ও জলাশয় ভরাট, বন জঙ্গল কমে যাওয়া, তাল, সুপারি ও নারিকেল গাছের মতো উঁচু গাছ হ্রাসের কারণেই বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে এসব উঁচু গাছের বজ্রপাতকে নিজের দিকে টেনে নেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।


এই বছর আবহাওয়ার ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বছরের শুরুতে মার্চ থেকে বজ্রপাতের প্রবণতা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এফ আর সরকার বলেন, গ্রীষ্মকালে বজ্রপাত সাধারণত আকাশ থেকে মাটিতে বেশি হয়। এর ফলে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বেশি। আর বর্ষাকালে বজ্রপাত হয় সাধারণত আকাশ থেকে আকাশে। ফলে মানুষ মারা যায় কম। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতের এই চরিত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রায় সারাবছরই বজ্রপাতে মানুষ মারা যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে শুরু থেকেই বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ কম বেশি ছিল। আগে বাংলাদেশে এই দুর্যোগের মাত্রা এত সাংঘাতিক ছিল না। ফলে বন্যা জলোচ্ছ্বাসকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা হলেও বজ্রপাতকে কখনো এই তালিকায় আনা হয়নি।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে এর মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালের বজ্রপাতকে প্রথমবারের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় নিয়ে আসা হয়েছে। এর পরেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারাদেশে ১০ লাখ তাল গাছ রোপণের প্রকল্প নেয়া হয়েছে।

আইডিইবির রিসার্চ ফেলো মোঃ ইয়াকুব হোসেন শিকদার ও মোঃ মনির হোসেন সম্প্রতি এই বিষয়ে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন বজ্রপাতে ২০১৫ সালে ২৭৪ জন, ১৬ সালে ৩৮৭ জন, ১৭ সালে ৩৭২ জন, ১৮ সালে ৪৪৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এদের অধিকাংশই প্রান্তিক গোষ্ঠীর যাদের মধ্যে প্রান্তিক ৩৪ ভাগ, নির্মাণ শ্রমিক ২৬ ভাগ, পথচারী ৯ ভাগ, সামরিক কাজে ৪ ভাগ, বার্জে ৪ ভাগ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ২৩ ভাগ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।


তারা বলেন, বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা গেলে উদ্বেগজনক প্রাণহানির হার কমিয়ে আনা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন সকালে আবহাওয়ার বার্তা পর্যবেক্ষণ করা, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকলে ঘন ঘন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পূর্বপ্রস্তুতি সম্পর্কে শ্রমিকদের অবহিত করার ব্যবস্থা করা দরকার। আর কর্মস্থলের নিকটবর্তী নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা অপরিহার্য।

আবহাওয়া অধিদফতরের হিসেবে আর এক সপ্তাহের মধ্যে দেশ থেকে বিদায় নেবে মৌসুমি বায়ু। আর এই বায়ু বিদায় নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ থেকে এক বছরের মতো বর্ষা ঋতু বিদায় নেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে এই বায়ুর ফলে বর্ষা ঋতু দীর্ঘ হয়। এর ফলে দেশে টানা চার মাস বৃষ্টি দেখা দেয়। কিন্তু এবার বর্ষাকালে স্বাভাবিক বৃষ্টির চেয়ে অনেক কম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, একমাত্র জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। রেকর্ডে দেখা গেছে পুরো বর্ষকাল জুড়েই বজ্রপাত অব্যাহত ছিল। এর কারণে প্রতিমাসেই মানুষের মৃত্যুর হার ছিল উদ্বেগজনক। এক সপ্তাহের মধ্যে মৌসুমি বায়ু বিদায় নেয়ার পর দেশে শীতের আগমনী বার্তা শুরু হবে। কিন্তু বজ্রপাতের আতঙ্ক এখনো থেকেই যাচ্ছে।

দুদিন আগেই বজ্রপাতে চাঁদপুর শহরে কুমিল্লা থেকে বেড়াতে আসা একই পরিবারের ৪ জন নিহত হয়েছেন। একই দিন মাগুরায় ২ জনের এবং বাগেরহাটে ১ জনসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা একটি অস্বাভাবিক বিষয়। সামনে শতি আসছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতে বৃষ্টির পরিমাণ কমছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেভাবে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে তাতে শীতে বৃষ্টি হলেও বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ফলে এই দুর্যোগ সারাবছরই স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে।
Courtesy: www.dailyjanakantha.com

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Responsive Ads Here