থ্যালাসেমিয়া
ডাঃ শায়লা শারমিন
থ্যালাসেমিয়া রক্তের একটি রোগ যা সাধারণত বংশগতভাবে ছড়ায়। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতি কম থাকে।Courtesy: ghr.nlm.nih.gov |
এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে, ভালোভাবে চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ১ লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
থ্যালাসেমিয়া কেন হয়?
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ।
একটি শিশু তার অবয়ব কেমন হবে, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, এগুলো নির্ভর করে তার বংশের যে জিন, তার ওপর।
ঠিক অনুরূপভাবে তার রক্ত কেমন তৈরি হবে, সেটিও নির্ভর করে তার বাবা-মা বা বাবা-মায়ের রক্তের কম্পোজিশন কেমন ছিল, বিশেষ করে হিমোগ্লোবিন তৈরির ক্ষেত্রে জেনেটিক যে কম্পোজিশন সেখান থেকে।
সেখান থেকে একজোড়া জিন নিয়ে, বাবার থেকে একটি, মায়ের থেকে একটি, দুটো জিন পেয়ে তার হিমোগ্লোবিন তৈরির প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হবে। সাধারণত ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা এবং মা উভয়ের অথবা বাবা অথবা মা যে কোনো একজনের থ্যালাসেমিয়া জিন থাকলে, এটি সন্তানের মধ্যে ছড়াতে পারে।
বাবা এবং মা উভয়ের থ্যালাসেমিয়া জিন থাকলে, সে ক্ষেত্রে শিশুর থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ২৫ ভাগ।
থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ
থ্যালসেমিয়া প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথা- আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া।
আলফা থ্যালাসেমিয়া
চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া ধারা গঠিত হয়।
এ ক্ষেত্রে বাবা এবং মা প্রত্যেকের কাছ থেকে দুটি করে এই জিন পাওয়া যায়। এর মধ্যে এক বা একাধিক জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়।
সমস্যাটি কতটা মারাত্মক তা নির্ভর করে চারটির মধ্যে কতটি জিন ত্রুটিপূর্ণ তার ওপর। যেমন- একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোনো লক্ষণ বা উপসর্গই দেখা যাবে না।
তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াতে পারে। দুটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মৃদু উপসর্গ দেখা যাবে। এই অবস্থা আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর নামে পরিচিত।
তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক ধরনের এর উপসর্গ দেখা যাবে।
এই অবস্থা হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ নামে পরিচিত।
Courtesy: www.differencebetween.net |
চারটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মারাত্মক ধরনের উপসর্গ দেখা যাবে এই অবস্থা আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর অথবা হাইড্রপস ফিটেইলস নামে পরিচিত। এর ফলে প্রসবের আগেই ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বিটা থ্যালাসেমিয়া
বিটা থ্যালাসেমিয়া ধারা দুটি জিন দিয়ে গঠিত হয়।
বাবা এবং মা প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে সর্বমোট দুটি জিন পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি অথবা উভয় জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও কতটা মারাত্মক তা নির্ভর করে চারটির মধ্যে কতটি জিন ত্রুটিপূর্ণ তার ওপর।
যেমন- একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মৃদু উপসর্গ দেখা যাবে। এই অবস্থা বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর নামে পরিচিত। অপরদিকে দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যাবে।
এ অবস্থা বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর অথবা কুলিস অ্যানিমিয়া নামে পরিচিত। যেসব নবজাতক শিশু এই সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকলেও জন্ম-পরবর্তী দুই বছর সময়ের মধ্যেই এই রোগের উপসর্গ দেখা যায়।
যাদের থ্যালাসেমিয়া রয়েছে, তারা হয়তো আলফা চেইন অথবা বিটা চেইন, একেবারেই তৈরি করতে পারে না। অথবা কম তৈরি করে।
এতে তার হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হয়ে যাচ্ছে। যেটুকু তৈরি হচ্ছে সেটি ত্রুটিপূর্ণ। ত্রুটিপূর্ণ হলো এই কারণে যে জিন দিয়ে যে গ্লোবিনের চেইনটা তৈরি হয়, সেই গ্লোবিন যদি কম পরিমাণের হয়, একটি চেইন যদি কম হয়, তাহলে সে প্রতিস্থাপন করার জন্য কাছাকাছি যারা রয়েছে তার সঙ্গে সমন্বয় করবে।
সমন্বয় হয়ে যে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়, সেই হিমোগ্লোবিনের জীবন বেশি দিনের হয় না।
এটি ১২০ দিন স্বাভাবিকভাবে থাকার কথা। তবে আগেই ভেঙে যাচ্ছে। এই থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের লোহিত কণিকা ১২০ দিনের পরিবর্তে ৩০/ ৪০ দিন বা ৫০ দিনেই ভেঙে যাচ্ছে। তাহলে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শিশু বয়সে বোনমেরু, যেখান থেকে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়, এর উৎপাদন ক্ষমতা কিছুটা বাড়তি থাকে। ছয় থেকে ১২ গুণ বেশি থাকে। এতে সে যদি কিছু হিমোগ্লোবিন কম তৈরি করেও, বোনমেরু কিন্তু তখন বেশি বেশি কাজ করে। আস্তে আস্তে যখন বয়স বাড়তে থাকে, যারা বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা ক্যারিয়ার, তাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরির ক্ষমতা কমতে থাকে। একটি সময়ে এসে কিন্তু তাদের রক্তস্বল্পতা হয়।
পক্ষান্তরে যারা থ্যালাসেমিয়া মেজর, বা ইন্টারমিডিয়েট, তাদের যে হিমোগ্লোবিনটা তৈরি হয় এটি আসলেই খুব কম এবং ত্রুটিপূর্ণ। ছোট বয়স থেকেই কিন্তু সে রক্তস্বল্পতায় ভোগে। এসব রোগীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা যেহেতু তাদের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত তৈরি করতে পারে না, তাই অন্যের রক্ত ট্রান্সফিউশন নিয়ে তাদের জীবন চালাতে হয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ
থ্যালাসেমিয়া রোগের ধরন এবং এর তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে এর উপসর্গগুলোও ভিন্ন হতে পারে। তবে থ্যালাসেমিয়া হলে সাধারণত কিছু লক্ষণ দেখে অনুমান করা যায়। যেমন-
অবসাদ বা অস্বস্তি অনুভব,
শারীরিক দুর্বলতা,
শ্বাসকষ্ট,
মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া,
মুখের হাড়ের বিকৃতি,
শারীরিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া,
পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা পেট ফুলে যাওয়া,
গাঢ় রঙের প্রস্রাব,
অতিরিক্ত আয়রন, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া,
হৃৎপিন্ডে সমস্যা,
ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া বা জন্ডিস ইত্যাদি লক্ষণ বা উপসর্গগুলো দেখা যায়।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা, লোহিত রক্তকণিকার আকারের পরিবর্তন, বিবর্ণ লোহিত রক্তকণিকা, লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিনের অসম থাকা, শিশুর রক্তে আয়রন ও লৌহের পরিমাণ, হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ইত্যাদি জানা যায়।
ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা অথবা রোগী ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিন বহন করছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়।
গর্ভস্থ সন্তানের থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোরিওনিক ভিলিয়াস স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটিসিস, ফিটাল বাড স্যাম্পলিং ইত্যাদি পরীক্ষা করা যেতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া আছে বা হতে পারে এরূপ সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে হবে।
No comments:
Post a Comment